জনসংখ্যা বিবর্তন তত্ত্ব (Demographic transition model) জনসংখ্যা বিবর্তন তত্ত্বের আলোকে ভারতের বর্তমান অবস্থা(Present status of India in the light of demographic transition model)
জনসংখ্যা বিবর্তন তত্ত্ব
Demographic transition model
যেকোনো দেশ বা অঞ্চলে জনসংখ্যা বৃদ্ধি বা পরিবর্তন প্রধানত জন্ম ও মৃত্যুহারের উপর নির্ভর করে। তবে অধিকাংশ জনসংখ্যাবিদের মতে প্রতিটি দেশের জনসংখ্যা একটি নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে কমে ,বাড়ে অর্থাৎ পরিবর্তিত হয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে ওয়ারেন্ট থম্পসন জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে অর্থনৈতিক উন্নতির সম্পর্ক বিশ্লেষণ করতে গিয়ে প্রথম জনসংখ্যা বিবর্তন তত্ত্বটি প্রকাশ করেন। জন্মহার ও মৃত্যুহার এর সঙ্গে আর্থ সামাজিক অবস্থার যে নিবিড় সম্পর্ক আছে তার ওপর ভিত্তি করে জনসংখ্যার বিবর্তন তত্ত্বটি গড়ে উঠেছে।
জনসংখ্যা বিবর্তন তত্ত্বের তিনটি মূল বিষয় হল-
- মৃত্যুহার জন্মহার এর আগেই হ্রাস পায়।
- শেষে জন্মহার মৃত্যুহারের সমান হয়।
- জনসংখ্যার বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সমাজের আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তন হয়।
জনসংখ্যা বিবর্তন তত্ত্বে মোট চারটি পর্যায়ের কথা বলা হলেও বর্তমানে জনসংখ্যা বিশারদরা আরো একটি পর্যায়ে যোগ করে মোট পাঁচটি পর্যায়ের কথা বলেছেন এই পাঁচটি পর্যায় হল -
প্রথম পর্যায়
- প্রাক শিল্প বিপ্লবের এই পর্যায় জন্মহার ও মৃত্যুহার খুবই বেশি প্রতি হাজারে ৪০ জনের বেশি তাই জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার খুবই কম।
- মোট জনসংখ্যা ছিল কম এবং জনঘনত্ব কম অথবা মাঝারি ধরণের।
- বৃহৎ পরিবার এবং নিরক্ষর জনসাধারণ।
- কৃষিভিত্তিক সমাজ ও উন্নত প্রযুক্তির অভাব।
- মানুষের প্রত্যাশিত আয়ুষ্কাল কম।
- অ-কৃষি ক্ষেত্রের উন্নতি একেবারেই নেই।
- অনুন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থার জন্য মহামারী এবং দুর্ভিক্ষ নিত্যসঙ্গী ।
উদাহরণ - বর্তমানে আফ্রিকা মহাদেশের গ্যাবন', জাম্বিয়া প্রভৃতি দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির এই প্রাচীন অবস্থা বিরাজমান।
দ্বিতীয় পর্যায়
- শিল্প বিপ্লবের সময় থেকে শুরু হওয়া এই পর্যায়ে জন্ম হার যথেষ্ট বেশি,কিন্তু মৃত্যু হার যথেষ্ট কম ও নিয়ন্ত্রিত।
- এই পর্যায়ে জনসংখ্যা অতি দ্রুত বৃদ্ধি পায় এমনকি জনবিস্ফোরণ ঘটতে পারে।
- আঞ্চলিক ও দেশীয় আর্থসামাজিক পরিকাঠামো ধীরে ধীরে উন্নত হয় এবং নগরায়ন ঘটে।
- কৃষির উন্নতির সঙ্গে শিল্প উন্নতি ঘটে।
- শিক্ষা স্বাস্থ্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটে।
উদাহরণ - ভারত, পাকিস্তান ,বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি এই পর্যায়ের অন্তর্গত দেশ।
তৃতীয় পর্যায়
- এই পর্যায়ে নারী শিক্ষার উন্নতি, শিশুদের শিক্ষার ব্যাপারে পিতা মাতার মনোযোগ বৃদ্ধি,গর্ভনিরোধক পদ্ধতি প্রভৃতি কারণে জন্ম আর নিম্নমুখী হয়।
- চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতির জন্য মৃত্যুহারও অনেক কম হয়।
- জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার আগের থেকে অনেক কম হয় এবং স্থিতিশীল হয়।
- কৃষি যন্ত্রিকরণ ও বাণিজ্যিক কৃষির প্রসার ঘটে।
- ব্যাপক নগরায়ন ঘটে ও শিল্পের প্রভূত উন্নতি হয়।
- সর্বোপরি সাক্ষরতা ও শিক্ষার হার বেশি হয়।
উদাহরণ - ব্রাজিল,আর্জেন্টিনা,মেক্সিকো, চিন প্রভৃতি তৃতীয় পর্যায়ের অন্তর্গত দেশ।
চতুর্থ পর্যায়
- জন্মহার ও মৃত্যুহার দুটোই বেশ কম এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধি হয় না বললেই চলে।
- এই পর্যায়ে হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, মধুমেয় প্রভৃতি ধরনের বিভিন্ন রোগ ও অস্বাভাবিক রকম স্থূলতার কারণে মৃত্যুহার আগের তুলনায় কিছুটা বৃদ্ধি পায়।
- মানুষের আয়ুষ্কাল বেড়ে যাওয়ার জন্য বয়স্ক জনসংখ্যা অনেক বেশি হয়।
উদাহরণ - দক্ষিণ কোরিয়া, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, সুইডেন ,ব্রিটেন ,আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র প্রভৃতি চতুর্থ পর্যায়ের অন্তর্গত দেশ।
পঞ্চম পর্যায়
- উন্নত জীবনযাত্রার মান, শিক্ষার সর্বাধিক প্রসার, নারীদের কর্মে নিযুক্তির উচ্চহার প্রভৃতির ব্যাপক প্রয়োগের ফলে জন্ম হার মৃত্যু হারের তুলনায় কম হয়।
- এই পর্যায়ে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ঋণাত্মক হয়।
- বয়স্ক জনসংখ্যা খুব বেশি।
- আর্থসামাজিক অবস্থা খুবই উন্নত।
উদাহরণ - জাপান, জার্মানি ,ইতালি, বেলজিয়াম, পোল্যান্ড প্রভৃতি পঞ্চম পর্যায়ের অন্তর্গত দেশ।
সমালোচনা
- পরিব্রাজনের ফলে জনসংখ্যার যে পরিবর্তন ঘটে সেই সম্পর্কে এই তত্ত্ব কোন আলোকপাত করেনি।
- বর্তমানে সারা বিশ্বের বহু দেশে Aids রোগ মরণশীলতার একটি প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে যা নিয়ে জনসংখ্যা বিবর্তন তত্ত্বে কিছু বলা হয়নি।
- কম উন্নত দেশগুলিতে তথ্য পাওয়ার অসুবিধার জন্য ভবিষ্যৎ জন্মহার, মৃত্যুহার ও মোট জনসংখ্যার সামগ্রিক চিত্রটি ব্যাখ্যা করা যায়নি।
- জনসংখ্যার বিবর্তন তত্ত্ব অনুসারে উচ্চ মৃত্যুহারের পর জন্মহার আবার বৃদ্ধি পায় এটা প্রমাণিত সত্য নয় কারণ ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে বিচার করলে দেখা যায় যে কোন বিপর্যয়জনিত কারণে বিপুল সংখ্যক মানুষ মৃত্যুবরণ করলে জনসংখ্যার সেই শূন্যতা ভরাট করতে বহু বছর সময় লাগে।
জনসংখ্যা বিবর্তন তত্ত্বের আলোকে ভারতের বর্তমান অবস্থা।
Present status of India in the light of demographic transition model.
ভারতের জন বিবর্তন তত্ত্বের যে বৈশিষ্ট্য গুলি পরিলক্ষিত হয় সেগুলি হল -
১৯২০ সালের পর থেকে ভারতের মৃত্যুহার উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে।
১৯০১ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত ভারতের মৃত্যুহার কমে হয় প্রতি হাজারে প্রায় ১২ থেকে ১১ জন।
বর্তমানে ভারতের শহরাঞ্চলের মৃত্যুহার প্রতি হাজারে প্রায় ১০ জন এবং গ্রামাঞ্চলে ১১ জন।
অন্যদিকে 1971 সালের পর থেকে ভারতে জন্মহার কিছুটা হ্রাস পেয়েছে।
১৯০১ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত ভারতে জন্মহার ছিল প্রতি হাজারে প্রায় ১৯ থেকে ৩০ জন।
বর্তমানে ভারতে জন্মহার প্রতি হাজারে প্রায় ১৭ জন।
চিকিৎসা ব্যবস্থার ব্যাপক প্রসার ঘটায় মৃত্যুহার অনেকটা নিয়ন্ত্রিত হয়েছে কিন্তু জন্মহার মৃত্যুহার তুলনায় যথেষ্ট বেশি তাই জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বেশি।
দেশের অর্থনৈতিক পরিকাঠামো ধীরে ধীরে উন্নত হচ্ছে।
ভারতের মিশ্র প্রকৃতির অর্থনীতি পরিলক্ষিত হয়, যা উন্নয়নশীল দেশের বৈশিষ্ট্য।
সুতরাং এই সমস্ত বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে বলা যায় যে,ভারত জন বিবর্তন মডেলের দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রায় শেষ প্রান্তে বা তৃতীয় পর্যায়ে প্রবেশের মুখে এসে উপস্থিত হয়েছে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন